বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

মিথ্যে কথা (কবিতা) – শঙ্খ ঘোষ

 


লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই

দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।
ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন
মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।
হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে
এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।
“ওমা , দেখো নৃত্যনাট্য” -যেই বলেছি আমি
মা বকে দেয় , “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।”
চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর
আদর করে দেখিয়ে দিলেন পশুরাজের কেশর।
ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী
ঠিক অবিকল সেইরকমই মূর্তি যেন দেখি ?
ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে
“জানিস ? আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে !”
শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন “শোন ,
এসব কথা আবার যেন না শুনি কখনো।”

বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব
কিন্তু সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব-
আকাশপারে আবার ও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।

মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে

 


প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে।

সকল দ্বন্দ্ব ঘুচবে আমার তবে।

 

       আর-যাহারা আসে আমার ঘরে

       ভয় দেখায়ে তারা শাসন করে,

           দুরন্ত মন দুয়ার দিয়ে থাকে,

               হার মানে না, ফিরায়ে দেয় সবে।

 

সে এলে সব আগল যাবে ছুটে,

সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে,

    ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে

        তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে।

 

       আসে যখন, একলা আসে চলে,

       গলায় তাহার ফুলের মালা দোলে,

           সেই মালাতে বাঁধবে যখন টেনে

               হৃদয় আমার নেরব হয়ে রবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ নামাও নামাও আমায় তোমার

 নামাও নামাও আমায় তোমার

                    চরণতলে,

       গলাও হে মন, ভাসাও জীবন

                    নয়নজলে।

                           একা আমি অহংকারের

                                  উচ্চ অচলে,

                           পাষাণ-আসন ধুলায় লুটাও,

                                         ভাঙো সবলে।

                           নামাও নামাও আমায় তোমার

                                         চরণতলে।

 

       কী লয়ে বা গর্ব করি

                    ব্যর্থ জীবনে।

       ভরা গৃহে শূন্য আমি

                    তোমা বিহনে।

                           দিনের কর্ম ডুবেছে মোর

                                         আপন অতলে

                           সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন

                                         যায় না বিফলে।

                           নামাও নামাও আমায় তোমার

                                         চরণতলে।

 

 

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ সভা যখন ভাঙবে তখন

      সভা যখন ভাঙবে তখন

                  শেষের গান কি যাব গেয়ে।

           হয়তো তখন কণ্ঠহারা

                  মুখের পানে রব চেয়ে।

           এখনো যে সুর লাগে নি

           বাজবে কি আর সেই রাগিণী,

           প্রেমের ব্যথা সোনার তানে

                  সন্ধ্যাগগন ফেলবে ছেয়ে?

     

                                      এতদিন যে সেধেছি সুর

                                             দিনেরাতে আপন-মনে

                                      ভাগ্যে যদি সেই সাধনা

                                             সমাপ্ত হয় এই জীবনে--

                                      এ জনমের পূর্ণ বাণী

                                      মানস-বনের পদ্মখানি

                                      ভাসাব শেষ সাগরপানে

                                             বিশ্বগানের ধারা বেয়ে।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ বিশ্ব যখন নিদ্রামগন

      বিশ্ব যখন নিদ্রামগন,

                  গগন অন্ধকার;

           কে দেয় আমার বীণার তারে

                  এমন ঝংকার।

           নয়নে ঘুম নিল কেড়ে,

                  উঠে বসি শয়ন ছেড়ে,

           মেলে আঁখি চেয়ে থাকি

                  পাই নে দেখা তার।র

     

                               গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া

                                      প্রাণ উঠিল পুরে,

                               জানি নে কোন্‌ বিপুল বাণী

                                      বাজে ব্যাকুল সুরে।

                               কোন্‌ বেদনায় বুঝি না রে

                                      হৃদয় ভরা অশ্রুভারে,

                               পরিয়ে দিতে চাই কাহারে

                                      আপন কণ্ঠহার।



    সবিতাঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     

    সবিতা

    সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
    মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে:
    ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি,
    তাহাদের সাথে
    সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন;
    মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী
    রেশম, মদের সার্থবাহ,
    দুধের মতন শাদা নারী।

    অনন্ত রৌদের থেকে তারা
    শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে
    সহসা বিকেলবেলা শেষ হ’য়ে গেলে
    চ’লে যেত কেমন নীরবে।
    চারিদিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র;
    মধ্যযুগের অবসান
    স্থির ক’রে দিতে গিয়ে ইওরোপ গ্রীস
    হতেছে উজ্জ্বল খ্রীষ্টান।

    তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা—
    সিন্ধুর রাত্রির জল জানে—
    আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে;
    কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে
    আমরা আকুল হ’য়ে উঠে
    মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধ করা হবে
    জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায়
    যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।

    

    এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;
    কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!
    তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
    কবেকার সমুদ্রের নুন;
    তোমার মুখের রেখা আজো
    মৃত কতো পৌত্তলিক খ্রীষ্টান সিন্ধুর
    অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন;
    কতো কাছে— তবু কতো দূর।

    সুরঞ্জনাঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     সুরঞ্জনা

    সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;
    পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
    কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো;
    গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
    শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে
    কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? —গিয়েছে হারায়ে।

    বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের
    ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;
    তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
    একটি পাখির গান কী রকম ভালো।
    মানুষ কাউকে চায়— তার সেই নিহত উজ্জ্বল
    ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।

    মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে
    ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে
    উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে
    তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে
    সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
    আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।

    যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা
    মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে
    ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
    আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;
    তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
    দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।

    অন্ধকারঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     অন্ধকার

    গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
    তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
    গুটিয়ে নিয়েছে যেন
    কীর্তিনাশার দিকে।

    ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম— পউষের রাতে—
    কোনোদিন আর জাগবো না জেনে
    কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর—

    হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
    তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
    হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে
    রয়েছে যে অগাধ ঘুম
    সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
    তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও—
    জানো না কি চাঁদ,
    নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
    জানো না কি নিশীথ,
    আমি অনেক দিন— অনেক অনেক দিন
    অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
    হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে
    বুঝতে পেরেছি আবার;
    ভয় পেয়েছি,
    পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
    দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
    মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
    আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
    আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়— বেদনায়— আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে;

    সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে
    উৎসব শুরু করেছে।
    হায়, উৎসব!
    হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
    আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
    অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
    থাকতে চেয়েছি।

    হে নর, হে নারী,
    তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;
    আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
    যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
    সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
    শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে,
    শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;
    এই সব ভয়াবহ আরতি!

    গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
    আমাকে কেন জাগাতে চাও?
    হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,
    আমাকে জাগাতে চাও কেন।

    অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর;
    তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
    অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
    কীর্তিনাশার দিকে।
    ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে—
    কোনোদিন জাগবো না জেনে—

    কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।

    তুমিঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     তুমি

    নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
    বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
    কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে— গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;
    আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প’ড়ে আছো তুমি।

    ‘মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছো? কিংবা দূর আকাশের পারে
    তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছো আঁধারে?
    ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে:
    মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি— তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে

    আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে
    আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’
    বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
    প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।

    আমাকে তুমিঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     আমাকে তুমি

    আমাকে
    তুমি দেখিয়েছিলে একদিন:
    মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল;
    দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
    দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়;
    জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
    জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে:
    পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।
    তারপর
    দূরে
    অনেক দূরে
    খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়
    এই দুপুরের বাতাস।

    এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন।

    বিকেলে নরম মুহূর্ত;
    নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;
    একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া
    আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো
    নদীর জলে
    সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে
    স্থির।

    মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
    আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ;
    বিকেলে
    অসম্ভব বিষণ্ণতা।

    ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে
    পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু—
    বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;

    শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়— ছায়ায়,
    রাত্রি;
    নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
    অতীত নিস্তব্ধতা।

    মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
    এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।

    বনলতা সেনঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     বনলতা সেন

    হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

    সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
    অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
    সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
    আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
    আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

    চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
    মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
    হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
    সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
    তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
    পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

    সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
    সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
    পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
    তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
    সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
    থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

    পথ হাঁটাঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

    পথ হাঁটা

    কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথে
    অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
    তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:

    সারা রাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো ক’রে জ্বলে।
    কেউ ভুল করেনাকো— ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
    চুপ হ’য়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।

    এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
    তখন অনেক রাত— তখন অনেক তারা মনুমেণ্ট মিনারের মাথা
    নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব

    আর-কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা-আর-মনুমেণ্ট-ভরা কলকাতা?
    চোখ নিচে নেমে যায়— চুরুট নীরবে জ্বলে— বাতাসে অনেক ধুলো খড়;
    চোখ বুজে একপাশে স’রে যাই— গাছ থেকে অনেক বাদামী জীর্ণ পাতা

    উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর

    কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর। 

    ধান কাটা হ’য়ে গেছেঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     ধান কাটা হ’য়ে গেছে

    ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন— খেতে মাঠে প’ড়ে আছে খড়
    পাতা কুটো ভাঙা ডিম— সাপের খোলস নীড় শীত।
    এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
    ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়।

    ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন,
    হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ;
    শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
    আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

    স্বপ্নের হাতেঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     স্বপ্নের হাতে

    পৃথিবীর বাধা— এই দেহের ব্যাঘাতে
    হৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতে
    আমি তাই
    আমারে তুলিয়া দিতে চাই।
    যেই সব ছায়া এসে পড়ে
    দিনের রাতের ঢেউয়ে— তাহাদের তরে
    জেগে আছে আমার জীবন;
    সব ছেড়ে আমাদের মন
    ধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতে
    পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
    বেদনা পেত না তবে কেউ আর—
    থাকিত না হৃদয়ের জরা—
    সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা।

    আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে,
    সারা দিন— সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে,
    পৃথিবীর যত ব্যথা— বিরোধ— বাস্তব
    হৃদয় ভুলিয়া যায় সব;
    চাহিয়াছে অন্তর যে-ভাষা,
    যেই ইচ্ছা— যেই ভালোবাসা
    খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে-পারে গিয়া—
    স্বপ্নে তাহা সত্য হ’য়ে উঠেছে ফলিয়া।
    মরমের যত তৃষ্ণা আছে—
    তারি খোঁজে ছায়া আর স্বপনের কাছে
    তোমরা চলিয়া এসো—
    তোমরা চলিয়া এসো সব!
    ভুলে যাও পৃথিবীর ওই ব্যথা— ব্যাঘাত— বাস্তব!
    সকল সময়

    স্বপ্ন— শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
    যাদের অন্তরে,
    পরস্পরে যারা হাত ধরে
    নিরালা ঢেউয়ের পাশে-পাশে—
    গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে
    যাহাদের আকাঙ্ক্ষার জন্ম— মৃত্যু— সব—
    পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব
    শোনে না তাহারা;
    সন্ধ্যার নদীর জল— পাথরে জলের ধারা
    আয়নার মতো
    জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত
    তাহাদের তরে।
    তাদের অন্তরে
    স্বপ্ন, শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
    সকল সময় …

    পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে
    আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে
    একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা—
    সে-সব ব্যর্থতা
    আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া;
    দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে
    ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া
    হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী
    ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়— ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি,
    তবে ওই পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে
    লিখিতে ষেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে
    অন্তরের কথা;
    আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে-সব ব্যর্থতা।

    পৃথিবীর ওই অধীরতা
    থেমে যায়— আমাদের হৃদয়ের ব্যথা
    দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে
    স্বপ্নেরে— ধ্যানেরে
    কাছে ডেকে লয়;
    উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,
    মানুষেরো আয়ু শেষ হয়।
    পৃথিবীর পুরানো সে-পথ
    মুছে ফেলে রেখা তার—
    কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
    চিরদিন রয়!
    সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব—
    নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়!

    সেদিন এ-ধরণীরঃ জীবনানন্দ দাশের কবিতা

     সেদিন এ-ধরণীর

    সেদিন এ-ধরণীর

    সবুজ দ্বীপের ছায়া—উতরোল তরঙ্গের ভিড়
    মোর চোখে জেগে-জেগে ধীরে-ধীরে হ’লো অপহত
    কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো।
    দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল,
    সহসা উজানজলে ভাটা গেল ভাসি,
    অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
    বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার।
    মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
    বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
    ভেসেছিলো আতুর উদাসী;
    বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
    কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি
    সেদিন শুনিনি তাহা;
    ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
    অতিদূর তারকার কামনায় আঁখি মোর দিয়েছিনু খুলে।

    সেইদিন মোর অভিসার

    আমার এ শিরা-উপশিরা
    চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,
    শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন—
    মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা—তোমার;
    ডেকেছিলো ভিজে ঘাস—হেমন্তের হিম মাস—জোনাকির ঝাড়,
    আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ—শ্মশানের খেয়াঘাট আসি,
    কঙ্কালের রাশি,
    দাউ-দাউ চিতা,
    কতো পূর্ব জাতকের পিতামহ পিতা,
    সর্বনাশ ব্যসন বাসনা,
    কতো মৃত গোক্ষুরার ফণা,
    কতো তিথি—কতো যে অতিথি—
    কতো শত যোনিচক্রস্মৃতি
    করেছিলো উতলা আমারে।
    আধো আলো—আধেক আঁধারে
    মোর সাথে মোর পিছে এলো তা’রা ছুটে,
    মাটির বাটের চুমো শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে, রোমপুটে;
    ধুধু মাঠ—ধানখেত—কাশফুল—বুনো হাঁস—বালুকার চর
    বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
    এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া;

    মাঝপথে থেমে গেল তা'রা সব;
    শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
    দূরে—দূরে—আরো দূরে—আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
    নিঃসহায় মানুষের শিশু একা—অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
    অসীমের আঁচলের তলে
    স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
    উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে—
    দূর ছায়াপথে।
    পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি
    সহসা উঠিল ভাসি তারকাদর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি;
    ভ্রূণভ্রষ্ট সন্তানের তরে
    মাটি-মা ছুটিয়া এলো বুকফাটা মিনতির ভরে;
    সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু—বৃদ্ধ মৃত পিতা,
    সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা,
    মোর পাশে দাঁড়ালো সে গর্ভিণীর ক্ষোভে;
    মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
    কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন—জননীর প্রাণ;
    জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান
    তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা শালতমালের ছায়া,
    এনেছে সে নব-নব ঋতুরাগ—পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া;
    তার তরে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
    মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজে রসে উঠিয়াছে ভরি,
    উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
    মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী;
    মশলাদরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে—
    কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু অমানিশা
    দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
    নয়ন মুদিনু ধীরে—শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে,
    সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।

    সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

    ক্যাম্পে

     ক্যাম্পে


    এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
    সারারাত দখিনা বাতাসে
    আকাশের চাঁদের আলোয়
    এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি—
    কাহারে সে ডাকে!

    কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
    বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিযাছে,
    আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,
    এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে
    ঘুম আর আসেনাকো
    বসন্তের রাতে।

    চারিপাশে বনের বিস্ময়,
    চৈত্রের বাতাস,
    জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন;
    ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;
    কোথাও অনেক বনে—যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই
    পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;
    তাহারা পেতেছে টের,
    আসিতেছে তার দিকে।
    আজ এই বিস্ময়ের রাতে
    তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
    তাহাদের হৃদয়ের বোন
    বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়—
    পিপাসার সান্ত্বনায়—আঘ্রাণে—আস্বাদে;
    কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন;

    মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই,
    সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;
    কেবল পিপাসা আছে,
    রোমহর্ষ আছে।
    মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়;
    লালসা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হ’য়ে উঠিতেছে সব দিকে
    আজ এই বসন্তের রাতে;
    এইখানে আমার নকটার্ন।

    একে-একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
    সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
    দাঁতের—নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই
    সুন্দরী গাছের নিচে—জ্যোৎস্নায়,
    মানুষ যেমন ক’রে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে
    হরিণেরা আসিতেছে।
    —তাদের পেতেছি আমি টের
    অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায,
    ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।
    ঘুমাতে পারি না আর;
    শুয়ে-শুয়ে থেকে
    বন্দুকের শব্দ শুনি;
    তারপর বন্দুকের শব্দ শুনি।
    চাঁদের আলোষ ঘাইহরিণী আবার ডাকে,
    এইখানে প’ড়ে থেকে একা-একা
    আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জ’মে ওঠে
    বন্দুকের শব্দ শুনে-শুনে
    হরিণীর ডাক শুনে-শুনে।

    কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
    সকালে—আলোয় তাকে দেখা যাবে—

    পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে।
    মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তাকে এই সব।

    আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো,
    …মাংস-খাওয়া হ’লো তবু শেষ?
    …কেন শেষ হবে?
    কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
    তাদের মতন নই আমিও কি?
    কোনো এক বসন্তের রাতে
    জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে
    আমাকেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায়—দখিনা বাতাসে
    ওই ঘাইহরিণীর মতো?

    আমার হৃদয়—এক পুরুষহরিণ—
    পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
    চিতার চোখের ভয়—চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
    তোমাকে কি চায় নাই ধরা দিতে?
    আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
    যখন ধূলায রক্তে মিশে গেছে
    এই হবিণীব মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি
    জীবনের বিস্ময়ের রাতে
    কোনো এক বসন্তের রাতে?

    তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে।
    মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস ল’য়ে আমরাও প’ড়ে থাকি;
    বিয়োগের—বিয়োগের—মরণের মুখে এসে পড়ে সব
    ঐ মৃত মৃগদের মতো।
    প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন ল’য়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা-মৃত্যু পাই;
    পাই না কি?

    দোনলার শব্দ শুনি।
    ঘাইমৃগী ডেকে যায়,
    আমার হৃদয়ে ঘুম আসেনাকো
    এক-একা শুয়ে থেকে;
    বন্দুকের শব্দ তবু চুপে-চুপে ভুলে যেতে হয়।

    ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;
    যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা ম’রে যায়
    হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে
    তাহারাও তোমার মতন;
    ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়
    কথা ভেবে—কথা ভেবে-ভেবে।
    এই ব্যথা—এই প্রেম সব দিকে র’য়ে গেছে—
    কোথাও ফড়িঙে-কীটে—মানুষের বুকের ভিতরে,
    আমাদের সবের জীবনে।
    বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো
    আমরা সবাই।

    অবসরের গান

     


    অবসরের গান

    শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
    অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে;
    মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
    তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
    দেহের স্বাদের কথা কয়;
    বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময়

    চারিদিকে এখন সকাল—
    রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল;
    মাঠের ঘাসের ’পরে শৈশবের ঘ্রাণ—
    পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান।

    চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
    তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
    প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
    পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
    শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে,
    যেই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে
    আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর,
    চারিদিকে ছায়া—রোদ—খুদ—কুঁড়ো—কার্তিকের ভিড়;
    চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হ’তেছে স্নিগ্ধ কান,
    পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ

    আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে
    বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার—
    শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে;
    আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,
    মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস;

    মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
    সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।

    গাছের ছায়ার তলে মদ ল’য়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিলো ছড়া!
    তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;
    ভুলে গিয়ে রাজ্য—জয়—সাম্রাজ্যের কথা
    অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিলো তুলে নেবো তার শীতলতা;
    ডেকে নেবো আইবুড়ো পাড়াগাঁর মেয়েদের সব;

    মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে—
    শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

    হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে
    কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;
    ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
    রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।
    আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
    আমাদের সকলের আগে শেষ হয়;
    দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ–অবসাদ–
    আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত।

    তখন শস্যের গন্ধ ফুরাযে গিয়েছে খেতে—রোদ গেছে প’ড়ে,
    এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধ’রে;
    তখন গিয়েছে থেমে ওই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়;
    হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালীর বিছানার ’পর;
    মদের ফোঁটার শেষ হ’য়ে গেছে এ-মাঠের মাটির ভিতর,
    তখন সবুজ ঘাস হ’য়ে গেছে শাদা সব, হ’যে গেছে আকাশ ধবল,
    চ'লে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদেব দল।



    পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে
    এসেছে বাহির হ’য়ে অন্ধকার দেখে
    মাঠের মুখের ’পরে;
    সবুজ ধানের নিচে—মাটির ভিতরে
    ইঁদুরেরা চ’লে গেছে; আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা;
    শস্যের খেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা।

    ফলন্ত মাঠের ’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান,
    প্রেম আর পিপাসার গান

    আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন;
    ফসল—ধানের ফলে যাহাদের মন
    ভ'রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা ক’রে গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন—
    আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়—
    যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়
    মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটিব নিচে পৃথিবীর তলে;
    কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে
    ফুরায়নি তাদের সময়,
    পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তা’রা করে নাই ভয়,
    প্রণয়ীর মতো তা’রা ছেঁড়েনি হৃদয়
    ছড়া বেঁধে শহরের মেযেদের নামে;
    চাষীদের মতো তা’রা ক্লান্ত হ’যে কপালের ঘামে
    কাটায়নি—কাটায়নি কাল;
    অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল
    কোনো এক সম্রাটের সাথে
    মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে,
    যোদ্ধা—জয়ী—বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে—পাশাপাশি—
    জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি!

    অনেক রাতের আগে এসে তা’রা চ'লে গেছে—তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার,
    সেই সব গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়—
    আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর?
    তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল;
    অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা—জানে তাহা
    নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল!
    সে-সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে
    তাহাদের নাম ধ’রে যায় ডেকে-ডেকে।

    মাটির নিচের থেকে তা’রা
    মৃতের মাথার স্বপ্নে ন'ড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভূত ইশারা!

    আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে—
    আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে।
    সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে
    শহর—বন্দর—বস্তি—কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে
    আসিয়াছি নেমে এই খেতে;
    শরীরের অবসাদ–হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে।
    শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধ’রে
    আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে
    দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন;
    অগাধ ধানের রসে আমাদের মন
    আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন

    জমি উপ্‌ড়ায়ে ফেলে চ’লে গেছে চাষা
    নতুন লাঙল তার প’ড়ে আছে—পুরানো পিপাসা
    জেগে আছে মাঠের উপরে;
    সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে!
    হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে—
    দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।

    আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে যায় চাঁদ;
    অবসর আছে তার—অবোধের মতন আহ্লাদ
    আমাদের শেষ হবে যখন সে চ’লে যাবে পশ্চিমের পানে,
    এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে।




    ফুরোনো খেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার;
    পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নেই, কোনো কৃষকের মতো দরকার নেই দূরে
    মাঠে গিয়ে আর;

    রোধ—অবরোধ—ক্লেশ—কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়,
    জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে—
    কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়;
    আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং;
    দামামা থামায়ে ফেল—পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক্
    রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।

    এখানে নাহিকো কাজ—উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকে ভাবনা;
    এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা।
    অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,
    পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।
    সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,
    গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,
    এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন—
    জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে।

    এখানে চকিত হ’তে হবেনাকো, ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়;
    উদ্যমের ব্যথা নাই—এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়;
    এইখানে কাজ এসে জমেনাকো হাতে,
    মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে;
    এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর,
    রাখিবে না চোখ আর নয়নের ’পর;
    ভালোবাসা আসিবে না—
    জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর।

    অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,
    পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়;
    সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,
    গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,
    এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে।


    লেখকের সম্পর্কে পড়ুন এখানে

    আবৃত্তি শুনতে ক্লিক করুন 

    মিথ্যে কথা (কবিতা) – শঙ্খ ঘোষ

      লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই। ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম ব...